আম চাষের পদ্ধতি

আমকে ফলের রাজা বলা হয়। এই ফলটিকে কম বেশি সবাই পছন্দ করে। আমাদের দেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আম উৎপাদিত হয়। সনাতন পদ্ধতির চাইতে আধুনিক পদ্ধতিতে  আম চাষ করলে  আমের উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশের অন্যান্য ফলের মধ্যে আম সবচাইতে বেশি উৎপাদন হয়।
আজ আমরা জানবো আমের জাত কতটি, কোন জাতের আম বেশি লাভজনক এবং জনপ্রিয়। কোন পদ্ধতিতে আম চাষ করলে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। এ সকল বিষয় নিয়ে আজকে আলোচনা করব। আম চাষের নতুন কার্যকরি পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এই পোস্টটি পড়তে হবে।


আম চাষের জন্য জমি এবং মাটি নির্বাচন 

সারা বাংলাদেশের সব জায়গায় আমগাছ রয়েছে অনেকে নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য আম গাছ লাগান আবার অনেকে চাহিদা পূরণের পরে বাজারে কিছু বিক্রি করেন। আম চাষের জন্য জমি এবং মাটির নির্বাচনের সময় উঁচু, রৌদ্দউজ্জল, যাতায়াত ব্যবস্থা সহ্‌ সেচ ব্যবস্থা এবং পানি জমে না এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। দোআঁশ মাটি আম চাষের জন্য উপযুক্ত। 

মাটির অম্লতা ৫.৫-৭.০ হলে আম চাষ ভালো হয়। মাটির অম্লতা এবং মাটির গঠন বৈশিষ্ট্য ভেদে আমের ভালো ফলন হয়ে থাকে। আম চাষের জন্য জমি বা মাটি  নির্বাচনের সময় সমতল এরূপ জায়গা বেছে নিতে হবে।  প্রয়োজন বোধে মাটি চাষ করে ভালোভাবে মই দিয়ে সমান করতে হবে মাটির সমান হলে পানি সেচ এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধা হয়। 


যদি মাটিতে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান না থাকে সেক্ষেত্রে ইউরিয়া, ডিএপ, পটাশ এবং সমপরিমাণ মতো জৈব সার দিয়ে মাটির সাথে ভালোমতো মিশিয়ে দিতে হবে। মাটি যত নরম এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হবে গাছ তো তাড়াতাড়ি বড় এবং ভালো ফলন দিবে। 

আমের চারা নির্বাচন এবং রোপণ পদ্ধতি 

আম চাষের জন্য আমের যারা নির্বাচন এবং রোপনের সময় সুস্থ দাদা দেখে তারা নির্বাচন করতে হবে। চারা রোপনের পূর্বে নির্ধারিত জায়গায় গর্ত করতে হবে। এবং ১০ থেকে ১২ দিন গর্তটাকে রোদে শুকাতে হবে। এরপর প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর সার ৫০০ গ্রাম টিএসপি ২৫০ গ্রাম এমপি ২৫০ গ্রাম জিপসাম ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট এবং ১০ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড মাটির সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত গর্ত ভরাট করতে হবে।

চারা রোপনের জন্য ৪ থেকে ৫  পাঁচ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ২ থেকে ৩টি ডাল বিশিষ্ট চারা নির্বাচন করতে হবে।গর্ত ভরাট করা ১০ থেকে ১৫ দিন পর পুনরায় গর্তের মাটি ভালোভাবে উল্টাপাল্টা করে গাছ গর্তের মাঝখানে বসিয়ে চারদিক থেকে মাটি দিয়ে সমানভাবে চাপ দিতে হবে।চাপ দেওয়ার সময় এমন ভাবে চাপ দেওয়া যাবে না যেন গাছের বেশিরভাগ অংশ মাটির ভিতরে ঢুকে পড়ে।


গাছ লাগানো শেষ হলে পানি দিয়ে গাছের গোড়া  ভিজিয়ে দিতে হবে।  জমিতে যদি রচনা থাকে সেক্ষেত্রে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। আম চাষের ক্ষেত্রে  নজর রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। মাটিতে পর্যাপ্ত রস এবং সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে।

গাছের নতুন পাতা বের হওয়ার পর অনেক পোকা আছে যেগুলো কচিপাতা কেটে দেয়। এরকম হলে প্রয়োজন বোধহয় ওষুধ দিতে হবে। গাছের সঠিক বৃদ্ধি এবং এক বছরের মাথায় মুকুল আসার জন্য আমের চারা নির্বাচন এবং রোপন পদ্ধতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুকুল আসার পূর্বে আম গাছের আগাম পরিচর্যা

আম গাছ রোপনের ১ বছর পর পুষ্টিগুণ অনুসারে কমবেশি প্রত্যেকটা গাছেই মুকুল আসে। মুকুল আসার পূর্বে বড় আম গাছগুলোর ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত,  একেবারে চিকন, মরা এইরকম ডালপালা ছাটাই করতে হয়। বাইরের ডালপালার তুলনায় ভেতরের ডাল পালায় তুলনামূলক আম কম হয় এবং মুকুল অনেক কম আসে। 
সেক্ষেত্রে মুকুল আসার পূর্বে আম গাছের সঠিক পরিচর্যার জন্য বড় বড় গাছের ভেতর মুখী ডালপালা কেটে দিতে হবে। এতে করে গাছটি কিছুটা পাতলা হবে এবং আলো বাতাস ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারবে। এতে রোগ বালাই কম এবং উৎপাদন ভালো হবে। মুকুল আসার আগে  প্রত্যেকটি আম গাছের গোড়ায় পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করতে হবে। 



১ বছর বয়সী গাছের ক্ষেত্রে উল্লেখিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে
  • ২০ কেজি গোবর সার 
  • ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া 
  • ১০০ গ্রাম টিএসপি 
  • ১০০ গ্রাম এম পি 
  • ১০০ গ্রাম জিপসাম 
  • ১০ গ্রাম জিংক সালফেট 
  • ৫ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড 
গাছ রোপনের ২ বছর পর নিম্নলিখিত হারে প্রয়োগ করতে হয়
  • ২৫ কেজি গোবর 
  • ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া 
  • ২০০গ্রাম টিএসপি 
  • ২০০ গ্রাম এমওপি 
  • ২০০ গ্রাম জিপসাম 
  • ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট 
  • ২৫ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড 
গাছের বয়স ২০ বছর ও এর ঊর্ধ্বে হলে 
  • ১২৫ কেজি গবর 
  • ২ কেজি ৭৫০ গ্রাম ইউরিয়া 
  • ২ কেজি ১৫০ টিএসপি 
  • ২ কেজি ১০০ গ্রাম এমপি 
  • ১ কেজি ৬০০ গ্রাম জিপসাম 
  • ১১০ গ্রাম জিংক সালফেট 
  • ৫০ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড। 
সারগুলো ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে এরপর গাছের চারপাশে মাটিকে ভালোভাবে কুপিয়ে নিতে হবে। এরপর কোপানো মাটির সাথে সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে পানির সেচ দিতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাহলে মাটির উপর কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন। এতে অনেক দিন পর্যন্ত মাটিতে রস থাকে। 
মুকুল আসার ১.৫ থেকে ২ মাস পূর্বে আম গাছে পানি এবং সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। তা না হলে গাছে মুকুলের পরিবর্তে বেশিভাগ পাতায় গাছ ভরে যাবে। অনেক সময় গাছের ডালে পরগাছা জন্মানোর কারনে গাছের ডালের শক্তি কমে যায়। এরুপ পরগাছা হলে তা কেটে ফেলতে হবে। আম চাষে যদি শতভাগ মুকুল আসে তাহলে অর্ধেক মুকুল ভেঙে দিতে হয়। 
ভেঙে দেওয়া ডালগুলোতে নতুন করে পাতা গজায়। এবং পরের বছরে ওই ডালগুলোতে মুকুল আসে। এবং উৎপাদন সমান হারে হয়।  আম গাছে বছরে দুইবার সার দিতে হয়। আমের মৌসুমী শেষ হলে গাছ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন উল্লেখিত পরিমান মত সার দিতে হবে। বর্ষা কালে সার ভালমতো ভিজে মাটির সাথে মিশে যায়।

আমের জাত নির্বাচন

বাংলাদেশর ৩০০টি মত আমের জাত রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আমের জাত বেশি পরিচিত।আমের জাত নির্বাচনের সময় যে আমের ফলন বেশি, জনপ্রিয়তা রয়েছে সেই জাত গুলো নির্বাচন করতে হবে। জনপ্রিয়তা জাতের মধ্যে রয়েছে ল্যাংড়া, গোপালভোগ, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, ক্ষীরপুলি, শাহী, রাজভোগ, মির্জাপুরী, কিষাণভোগ, ফজলি, চসা, আশ্বিনা, খিরসা পাতি, হিমসাগর, অমৃতভোগ, রানী পছন্দ, কৃষ্ণভোগ, দিল পছন্দ, বোম্বাই (মালদা), সূর্যপুরী, মিসরীভোগ, শ্রীধন, গোলাপ খাস, বৃন্দাবনী, দিল খোশ, হাড়ি ভাংগা, কোহিনুর ইত্যাদি। 
বাংলাদেশে জন্মায় তেমন কিছু উৎকৃষ্ট জাতের মধ্যে রয়েছে লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, ক্ষীরপুলি, শাহী-পছন্দ, রাজভোগ, মির্জাপুরী, অমৃতভোগ, রানী পছন্দ, কৃষ্ণভোগ, দিল পছন্দ, বৃন্দাবনী, দিল খোশ, হাড়ি ভাংগা, কোহিতুর ইত্যাদি। আশ্বিনা, বারমাসী ও কাঁচা মিঠা জাতগুলো ও বেশ জনপ্রিয়। 

আমের জাতের মধ্যে কিছু মজাদার নামও আছে যেমন কোহিনুর, চৈতালী, জাফরান, দিল খোস, দুধ কুমার, দুধসর, বাবুই ঝাঁকি, মধুচাকী, মিঠুয়া, শ্রাবণী, স্বর্ণরেখা, সুবর্ণরেখা, ক্ষীরপুলি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের প্রধান আম হল ফজলি।সব জাতের আম যখন শেষ হয়ে যায় তখন বাজারে আসে আঁশহীন, অতি সুস্বাদু এই জাতের বৃহদাকৃতির আম। এছাড়া ও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত হল ল্যাংড়া। সুগন্ধী, অতি সুমিষ্ট, আঁশহীন লম্বা এই আমটিকে প্রায় সবাই পছন্দ করে। মিষ্টি, আঁশহিন, শাঁসযুক্ত আর ও ২ টি জাত হল, হিমসাগর, গোপালভোগ। 
কাচাই মিঠা নামের একটি জাত আছে, এ আম কাঁচাই খাওয়া যায়। বারমাসি জাতের আম গাছে বছরে ২-৩ বার আম ধরে। এক দিকে যেমন ১-২ কেজি ওজনের আম রয়েছে তেমনি আবার ছোট ছোট আম ও রয়েছে। এই সব আম আঁটির আম নামে পরিচিত। এই সব আম গুলো ও বেশ মিষ্টি হয়। এই সব আমের আঁটি বড় হয় এবং শাঁস ছোট হয়।বর্তমানে জনপ্রিয় জাতের ১০টি আম। 


বর্তমানে জনপ্রিয় জাতের ১০টি আমের মধ্যে রয়েছে
  • আম্রপালি
  • ক্ষীরশাপাতি
  • ল্যাংড়া
  • গোপালভোগ
  • মোহনভোগ
  • হিমসাগর
  • বোম্বাই
  • বারি আম ১,২,৩,৪,৫,৬,৭, ৮,৯,১০,১১,১২,১৩,১৪,১৫,১৬,১৭, এবং সর্বশেষ ১৮ উদ্ভাবিত হয়।
  • হারিভাঙ্গা
  • এবং ফজলি
এই সব আম গাছের আকার মাঝারি ধরনের। এই গাছ গুলোতে আম ব্যাপক ধরে।

উচ্চ ফলনশীল জাতের আম

উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে বারি উদ্ভাবিত আমের উচ্চফলনশীল জাতগুলো হলো: বারি আম-১, ২ ও বারি আম-৩ (আম্রপালি), ৪ (হাইব্রিড); ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ও বারি আম-১১ (বারোমাসি) এবং বারি আম-১২ (নাবি জাত)। বারি ১৫,১৬,১৭ এই তিন জাতের আমি মৌসুমের শেষের দিকে পাকে। সবগুলো জাতি উচ্চ ফলনশীল প্রতিবছর ফলন দেয় অনেক। সবগুলো আমের ওজন প্রায়ই আধা কেজির মত আকার এবং ওজনের দিক থেকেও এই আমগুলো বেশ ভালো।

লেখকের মন্তব্য

আমাদের এই পোস্টটি পরে যদি আপনার কাছে ভাল লাগে বা একটু হলেও আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই এই পোস্টটি আপনার বন্ধুদের সাথে বেশি বেশি শেয়ার করবেন। আপনার শেয়ার করা এই পোস্টটির মাধ্যমে আপনার বন্ধুরাও জানতে পারবে এবং উপকৃত হবে। তাই আর দেরি না করে সবার সাথে পোস্টটি শেয়ার করুন।

পোস্টটি পরে আপনাদের যদি কোন মতামত থাকে বা কিছু জানার থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url